ইতিহাস-ঐতিহ্য ডেস্ক : ২৩ জুলাই ২০২৫, বুধবার, ১২:১৪:০৮
কাশ্মীরে পর্যটক হত্যা নিয়ে পাকিস্তান-ভারত চারদিনের যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে স্বল্পস্থায়ী অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই যুদ্ধে অসাধারণ নেতৃত্ব ও দেশের পক্ষে অবদানের জন্য তাকে এই মর্যাদাপূর্ণ পদ দেওয়া হয়েছে।
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, শেষবার প্রায় ৬৬ বছর আগে, অর্থাৎ ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানের কোনো সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শালের পদে আসীন হয়েছিলেন। প্রেসিডেন্সিয়াল ক্যাবিনেট তৎকালীন সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে সেই সম্মানজনক পদ দিয়েছিল।
আইয়ুব খান ব্রিটিশ রয়্যাল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্স্ট থেকে সামরিক জীবন শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯৫৮ সালের অক্টোবরে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং পরে ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
ফিল্ড মার্শাল: ইতিহাস–উৎপত্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
ফিল্ড মার্শাল পদটি মূলত পাঁচ তারকাবিশিষ্ট সর্বোচ্চ সামরিক পদ। পুরোনো জার্মান ভাষায় এর অর্থ রাজার ঘোড়ার তত্ত্বাবধায়ক বা অধিনায়ক। এই পদের ইতিহাস প্রায় ৮৪০ বছরের পুরোনো। ১১৮৫ সালে ফ্রান্সের রাজা ফিলিপ অগাস্তাস জেনারেল আলবারিক ক্লেমেন্টকে বিশ্বের প্রথম ফিল্ড মার্শাল হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
জেনারেল ক্লেমেন্ট তৃতীয় ক্রুসেডে (জেরুজালেম দখলের যুদ্ধ) রাজা ফিলিপের সঙ্গে ছিলেন। তিনি ১১৯১ সালে যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন। এরপর বিভিন্ন দেশে শত শত ফিল্ড মার্শাল নিযুক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু যুক্তরাজ্যে ১৪১ জন এবং রুশ সাম্রাজ্যে ৬৪ জন ফিল্ড মার্শাল নিয়োগ পেয়েছিলেন।
ভারতের প্রথম ফিল্ড মার্শাল ছিলেন জেনারেল স্যাম মানেকশ। তিনি ১৯৭৩ সালে এই পদে উন্নীত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার নেতৃত্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। পরে এ যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হয়।
ফ্রান্সে ১৭৯৩ থেকে ১৮০৪ সাল পর্যন্ত এই পদটি বিলুপ্ত অবস্থায় ছিল। তবে পরে এই পদটি আবার প্রবর্তন করা হয় এবং খোদ নেপোলিয়ন নিজেই ফিল্ড মার্শাল হন। জার্মানিতে এই পদটি চালু হয় ১৬৩১ সালে। জার্মানির প্রথম ফিল্ড মার্শাল ছিলেন জেনারেল হান্স বয়েটজেনবুর্গ।
১৭০০ সালে রাশিয়ার কাউন্ট গোলভিন ফিল্ড মার্শাল হন। ১৭৩৬ সালে ব্রিটেনের জেনারেল জর্জ হ্যামিল্টন এই পদে ভূষিত হন। ‘এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা’ ও ‘অক্সফোর্ড ডিকশনারি অব ন্যাশনাল বায়োগ্রাফি’ সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
মর্যাদাপূর্ণ এই পদ বহু দেশের সামরিক বাহিনীতে দেখা গেছে। যেমন গ্রেট ব্রিটেন, ভারত, পাকিস্তান, চীন, ফিনল্যান্ড, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া, ইতালি, ব্রুনেই, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, গ্রিস, জাপান, তুরস্ক, সৌদি আরব, পর্তুগাল, পোল্যান্ড, সুইডেন, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, নাইজেরিয়া, ব্রাজিল, ওমান, দক্ষিণ ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, আলবেনিয়া, জায়ার, নেপাল, মঙ্গোলিয়া, ইথিওপিয়া, মিসর, বেলারুশ, বাহরাইন, ইয়েমেন, ফিলিপাইন, পেরু, উত্তর কোরিয়া, ঘানা, যুগোস্লাভিয়া, ভেনেজুয়েলা, উগান্ডা, জর্ডান, ইরান, ইরাক, লাইবেরিয়া, রোমানিয়া, ক্রোয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, মধ্য আফ্রিকান রিপাবলিক, তিউনিসিয়া, সুদান, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা, সার্বিয়া, সিরিয়া ইত্যাদি দেশ।
জেনারেল স্যাম মানেকশ ১৯৭৩ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রথম কর্মকর্তা হিসেবে ফিল্ড মার্শালের পদে উন্নীত হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বে তখন ভারতীয় বাহিনী ১৯৭১ সালে যুদ্ধে অংশ নেয়।
ভারতের প্রথম সেনাপ্রধান জেনারেল মদাপ্পা কারিয়াপ্পা। তিনি ১৯৪৭-৪৮ সালের যুদ্ধের সময় সেনাবাহিনী পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁকেও ১৯৮৬ সালে ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করা হয়। মানেকশ ও কারিয়াপ্পা দুজনই ৯৪ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
তৎকালীন লিয়ালপুরে (বর্তমান ফয়সালাবাদ) জন্ম নেওয়া ভারতীয় বিমানবাহিনীর অফিসার অর্জন সিং ২০০২ সালে মার্শাল অব দ্য এয়ারফোর্স হন। তিনি ১৯৬৫ সালে বিমানবাহিনী পরিচালনা করেন এবং ২০১৭ সালে ৯৮ বছর বয়সে মারা যান।
তামিল টাইগারদের পরাজিত করার পুরস্কার হিসেবে শ্রীলঙ্কার সেনাপ্রধান সারথ ফনসেকাও এই পদে উন্নীত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি ২০১০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হলেও রাজাপক্ষের কাছে পরাজিত হন। পরে তাঁকে এই পদ ও সম্মাননা থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
তবে ২০১৫ সালে নতুন প্রেসিডেন্ট সিরিসেনা সাবেক এই সেনাপ্রধানকে পূর্ণ ক্ষমা ঘোষণা করেন এবং আবার ফিল্ড মার্শাল পদে উন্নীত করেন।
নেপালের রাজা বীরেন্দ্র ও মহেন্দ্র ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল ছিলেন। ব্রিটেন প্রায় এক ডজন বিদেশি রাজাকে কূটনৈতিক সম্মানের দৃষ্টান্ত হিসেবে এ খেতাব দিয়েছে।
তবে জার্মান সম্রাট উইলহেল্ম দ্বিতীয়, অস্ট্রিয়ার সম্রাট ফ্রান্স জোসেফ প্রথম এবং জাপানের সম্রাট হিরোহিতোর কাছ থেকে এই পদ কেড়ে নেওয়া হয়। কারণ, দুই বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁদের নিজ নিজ দেশ ব্রিটেনের শত্রু হয়ে ওঠায় তাঁদের সরানো হয়।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী আর্থার ওয়েলেসলি ১৮১৩ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে এই পদ পান। ১৮২১ সালে ৯১ বছর বয়সে চার্লস মুর এই পদ পেয়েছিলেন। ব্রিটেনে এমন ২৩ জন কর্মকর্তা আছেন, যাঁরা ৮০ বা তার বেশি বয়সে ফিল্ড মার্শাল হয়েছিলেন। ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের মধ্যেও অনেকে এই পদ পেয়েছেন, যেমন রাজা জর্জ পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম, প্রিন্স চার্লস, প্রিন্স এডওয়ার্ড এবং রানি এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপ।
রানি ভিক্টোরিয়া তার স্বামী প্রিন্স অ্যালবার্টকে ফিল্ড মার্শাল পদ দিয়েছিলেন। তার নাতনি রানি এলিজাবেথও একই কাজ করেন। জেনারেল চার্লস গাথরি ২০১২ সালে ও জেনারেল জন ওয়াকার ২০১৪ সালে এই পদে উন্নীত হন।
তুরস্কের প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কও একজন ফিল্ড মার্শাল ছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রে কখনো ফিল্ড মার্শাল পদ চালু হয়নি। তবে ১৯৩৬ সালে জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারকে ফিলিপিনো সেনাবাহিনীর ফিল্ড মার্শাল পদে নিযুক্ত করা হয়। ১৯৪৪ সালে মার্কিন কংগ্রেস ‘জেনারেল অব দ্য আর্মি’ নামে একটি পাঁচ তারকা পদ চালু করে, যা ফিল্ড মার্শালের সমতুল্য।
এর দুই দিন পর জেনারেল জর্জ মার্শাল এই পদে উন্নীত হন এবং তিনি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম পাঁচ তারকা জেনারেল।
সৌদি আরবে ১৯৯০-৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধে অবদানের জন্য প্রিন্স খালেদ বিন সুলতানকে এই পদে উন্নীত করেন বাদশাহ ফাহদ।
Tags: পাকিস্তান, ফিল্ড মার্শাল, ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ, সেনাবাহিনী
Rent for add